
চট্টগ্রামে বন উজাড় করে অর্থনৈতিক অঞ্চল
- আপলোড সময় : ২৯-০৪-২০২৫ ১১:৪৯:৫১ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৯-০৪-২০২৫ ১১:৪৯:৫১ পূর্বাহ্ন


চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার উপকূলীয় বনাঞ্চলে একসময় হরিণ ছিল ১০-১২ হাজার। সেই সংখ্যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪০০ মাত্র! অন্যান্য বন্যপ্রাণী ও গাছ-গাছালির সংখ্যাও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে উপকূলীয় বনাঞ্চল ধ্বংস করায় হরিণ কমেছে বলে জানান উপকূলীয় রেঞ্চ কর্মকর্তা আব্দুল গফুর মোল্লা। তবে নতুন করে উপকূলীয় বনাঞ্চল গড়তে সুফল প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪১ লাখ চারার বাগান সৃজন করা হয়েছে বলে দাবি তার। মিরসরাই উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়তে মিরসরাই উপজেলার সাহেরখালী, ইছাখালী ও মঘাদিয়া ইউনিয়নের উপকূলীয় অঞ্চলের ২২ হাজার ৩৩৫ একর বনাঞ্চল নিয়ে নেয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এসব বনাঞ্চলে বাইন, কেওড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিল। ছিল হরিণ, শিয়াল, মেছোবাঘ, লজ্জাবতী বানর, বেজি, সাপসহ বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী। কিন্তু জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় উপকূলীয় বনগুলোর বেশিরভাগ ধ্বংস করায় বন্যপ্রাণীগুলো কমে গেছে। বিশেষ করে হরিণের সংখ্যা কমেছে উল্লেখ্যযোগ্য হারে। উপকূলীয় এসব বনে প্রায় ১০-১২ হাজার হরিণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এর ৮০ শতাংশ কমে গেছে। ২০২২-২০২৪ সালে উপকূলীয় বনাঞ্চল থেকে চারটি মরা ও চারটি আহত হরিণ উদ্ধার করা হয়। এগুলোর মধ্যে ২০২২ সালের ৪ মার্চ সাহেরখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ মঘাদিয়া ঘোনা এলাকার উপকূলীয় বেঁড়িবাধের ওপর থেকে উদ্ধার করা হয় দুটি মরা হরিণ। হরিণগুলোর শরীরের আঘাতের চিহৃ ছিল। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ধারণা, সড়ক পারাপার হওয়ার সময় হরিণ দুটি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেছে। ২০২৩ সালের ১২ মে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পুলিশ ক্যাম্পের পাশ থেকে আরও একটি মরা হরিণ উদ্ধার করে উপকূলীয় বন বিভাগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অর্থনৈতিক অঞ্চলের জিরো পয়েন্টের পশ্চিম পাশে বনাঞ্চল উজাড় করা হয়েছে। এখন ১০ একরের মতো বন রয়েছে। সেখানে শতাধিক হরিণের বিচরণ চোখে পড়ে। তবে সেই বনেও চোখ পড়েছে বনখেকোদের। অনেক অসাধু ব্যক্তি সেই বাগান কেটে মাছের প্রকল্প করার পাঁয়তারা করছেন।
সাহেরখালী ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দা আব্দুল কাইয়ুম বলেন, আগে উপকূলীয় বনাঞ্চলে অসংখ্য হরিণ দেখা যেতো। কিন্তু জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে উপকূলীয় বনাঞ্চল ধবংস করায় হরিণগুলো আশপাশের উপজেলা সুরবর্ণচর ও হাতিয়ায় চলে গেছে। তবে মাঝে মধ্যে মরা কিংবা আহত অবস্থায় কয়েকটি হরিণ উদ্ধার করে বন বিভাগকে খবর দেন স্থানীয়রা।
সূত্র জানায়, জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নেয়া ২২ হাজার ৩৩৫ একর উপকূলীয় বনাঞ্চলের মধ্যে চার হাজার ১০৪ একর বনাঞ্চল ফেরত দিতে ২০২৪ সালে চিঠি দেয় বন মন্ত্রণালয়। ওই বনাঞ্চলে কেওড়া, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। বনাঞ্চলটি ফেরত পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী বন বিভাগ।
বেজা সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে গভর্নিং বোর্ডের সভায় মিরসরাইয়ে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১৬ সালে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি উদ্বোধন করা হয়। বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা সন্দ্বীপ চ্যানেলের পাশে প্রায় ১৩৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে এই জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বেজার মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলাজুড়ে এই শিল্পনগরের আয়তন ৩৩ হাজার ৮০৫ একর। এর ৪১ শতাংশ বা ১৪ হাজার একরে শুধু শিল্পকারখানা হবে। বাকি ৫৯ শতাংশ এলাকার মধ্যে আছে খোলা জায়গা, বনায়ন, বন্দর সুবিধা, আবাসন, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ও বিনোদন কেন্দ্র। সেখানে জমি বরাদ্দের জন্য ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে আবেদন নেয়া শুরু করে বেজা। ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের বেপজা ইকোনমিক জোন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। ২০২২ সালের মার্চ মাসে উৎপাদন শুরু করে চারটি প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে প্রায় ২০টির অধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ শুরু করেছে ওই অঞ্চলে। অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা বাস্তবায়িত হলে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে জানিয়েছেন বেজার কর্মকর্তারা।
এদিকে উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় সুফল প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪১ লাখ বিভিন্ন প্রজাতির চারার বাগান সৃজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে উপকূলীয় বন বিভাগ। এগুলোর মধ্যে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বামনসুন্দর ও মঘাদিয়া বিটের আওতায় ১০০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজন করা হয়। ওই দুই বিটে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নির্মিত সুপার ডাইকের বাইরে ৩ নম্বর সড়কের বসুন্ধরা সাইট অফিসের দক্ষিণ পাশে ৩০ হেক্টর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের ১ নম্বর ব্রিজের পাশে ৭০ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ৫০০ বেডের বীজতলা তৈরি করে বীজ বপন করা হয়েছিল অর্থনৈতিক অঞ্চলে। ওই বছরের মার্চ থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোপণকৃত বীজতলার চারাগুলো (সাড়ে চার লাখ) উত্তোলন করে রোপণ করা হয়েছে। প্রতি হেক্টরে চার হাজার ৪৪৪টি কেওড়া, বাইন প্রজাতির চারা রোপণ করা হয়। এদের মধ্যে মঘাদিয়া বিটের ৩০ হেক্টর জায়গায় এক লাখ ৩৩ হাজার ৩২০টি ও বামানসুন্দর বিটের ৭০ হেক্টর জায়গায় তিন লাখ ১১ হাজার ৮০টি চারা রোপণ করা হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন অর্থবছরে প্রায় ৪১ লাখ চারা রোপণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে উপকূলীয় বন বিভাগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরসরাই উপকূলীয় রেঞ্চ কমকর্তা আব্দুল গফুর মোল্লা বলেন, মিরসরাইয়ে অবস্থিত জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ২২ হাজার ৩৩৫ একর উপকূলীয় বনাঞ্চল নির্ধারণ করা হয়। ওই সব বনে কেওড়া, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিল। ছিল বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী। তবে হরিণের সংখ্যা ছিল বেশি। এগুলোর মধ্যে আমরা ৪ হাজার ১০৪ একর বনাঞ্চল ফেরত পেতে আবেদন করেছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে উপকূলীয় বনাঞ্চলে প্রায় ১০-১২ হাজার হরিণ ছিল। বর্তমানে উপকূলীয় বনাঞ্চলের ৮০ শতাংশ হরিণ হারিয়ে গেছে। জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও উপকূল রক্ষায় আমরা সুফল প্রকল্পের আওতায় নতুন করে ৪১ লাখ চারা রোপণের মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ বাগান সৃষ্টি করছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক শেখ আবুল কালাম আজাদ বলেন, মিরসরাইয়ে আগে হরিণ অনেক বেশি ছিল, এটা স্বাভাবিক। এটি ইকো সিস্টেমের অংশ। খাদ্য যখন বেশি থাকবে বন্যপ্রাণীও বেশি থাকবে। এখন বন কমে গেছে, হরিণও কমে গেছে। তিনি আরও বলেন, আমরা মিরসরাই ও সীতাকুণ্ডে এক থেকে দেড় হাজার নতুন বন সৃষ্টি করেছি। আমরা যদি এই বন রক্ষা করতে পারি, আবারও হরিণের বাসস্থান ফিরিয়ে আনতে পারবো।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ